শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৫
ঢাকা শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৫, ১২ বৈশাখ ১৪৩২
The Daily Post

লবণপানির ধাক্কায় দিশাহারা কৃষক

নড়াইল প্রতিনিধি

লবণপানির ধাক্কায় দিশাহারা কৃষক

সামুদ্রিক উপকূলীয় এলাকা না হলেও নড়াইলের নদী ও খালের পানিতে প্রতি বছর লবণাক্ততা বাড়ছে। লবণপানি বৃদ্ধির ফলে নদী ও খালের পানি সেচের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ফলে নদী ও খালের পানি সেচের কাজে ব্যবহার করতে পারছেন না প্রান্তিক কৃষকরা।

বাধ্য হয়ে মাটির নিচ থেকে স্যালো মেশিনে পানি উত্তোলন করে চাষাবাদ করতে হচ্ছে তাদের। ফলে বোরো আবাদসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদনে সেচ খরচ বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। জমিতে লবণপানি প্রবেশ করায় অন্তত ৫ হাজার একর তিন ফসলি জমি এক ফসলি জমিতে পরিণত হচ্ছে প্রতি বছর। এমন পরিস্থিতিতে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন এই জনপদের ক্ষতিগ্রস্ত হাজারো প্রান্তিক কৃষক।

এ প্রসঙ্গে যশোর মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. মোতাসীম আহমেদ বলেন, নড়াইল জেলায় মধুমতী নদীর কালনাঘাট, নবগঙ্গা নদীর বারইপাড়া, চিত্রা নদীর আউড়িয়া এবং আফরা নদীর তুলারামপুর পর্যন্ত পানি বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত লবণাক্ত থাকে। নদীর পানি ও লবণক্ততা প্রধানত উজান থেকে পানির প্রবাহ এবং উজানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে। উজানে পানির প্রবাহ বেশি এবং অধিক পরিমাণে বৃষ্টিপাত হলে লবণাক্ততা কমে যায়।

ফারাক্কা দিয়ে পানিপ্রবাহ যত বেশি থাকবে এ অঞ্চলের নদী ও খালগুলোর পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ তত কম থাকবে। ফারাক্কার পানিপ্রবাহ কম থাকলে নদী ও খালের পানিতে লবণের মাত্রা বেড়ে যায়। আবার বৃষ্টিপাত যত বেশি হবে পানিতে লবণের মাত্রা তত কম থাকবে। যে বছরে বৃষ্টি কম হয় সেই বছর লবণাক্ততার মাত্রা বেড়ে যায়।

নড়াইল বিএডিসির সহকারী প্রকৌশলী (ক্ষুদ্র সেচ) মো. মেশকাত আলী বলেন, কৃষকরা নদী ও খালের পানি ব্যবহার করতে না পেরে বাধ্য হয়েই ভূগর্ভস্থ পানির ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। এতে ক্ষেতের বোরো ধানসহ বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। ভূগর্ভস্থ পানির ওপর এত বেশি নির্ভরশীল হলে আগামী দিনে কৃষকরা আরও ঝুঁকির মধ্যে পড়বেন।

নড়াইল সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. রোকনুজ্জামান বলেন, যেসব এলাকায় লবণপানি প্রবেশ করছে সেসব এলাকার কৃষকরা তাদের জমিতে বাধ্য হয়ে সার বেশি ব্যবহার করছেন। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা। এসব এলাকার কৃষকদের লবণসহিষ্ণু ফসল চাষাবাদের জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৯৬৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের কৃষিপ্রধান জেলা নড়াইল। আট লাখ মানুষের বসবাস এখানে। জেলার মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে চিত্রা নদী। বিল ও ঘেরবেষ্টিত এই জেলার মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস কৃষিকাজ ও মৎস্য চাষ।

জেলায় তেমন কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে না ওঠায় এ জনপদের বেশিরভাগ মানুষ কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল। নড়াইল জেলার মধুমতী, আফরা, নবগঙ্গা ও চিত্রা নদীর পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় সেচের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে এসব নদীর সঙ্গে সংযুক্ত বিভিন্ন খাল, বিল ও জলাশয়ের পানি। ফলে চরম বিপাকে পড়ে গেছেন হাজারো প্রান্তিক কৃষক। বাধ্য হয়ে এসব কৃষকরা মাটির নিচ থেকে পানি উত্তোলন করে জমিতে সেচ দিচ্ছেন। ফলে এসব এলাকার কৃষকদের সেচ খরচ বেড়ে গেছে দ্বিগুণেরও বেশি।

যশোর মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা গেছে, নড়াইল জেলায় ২০০০ সালের একটি সার্ভে রিপোর্টে পানিতে প্রথম লবণাক্ততা ধরা পড়ে। তখন এর এরিয়া ছিল ১৬ হাজার হেক্টর জমি। পরে ২০০৯ সালের সার্ভেতে প্রায় ১৯ হাজার হেক্টর জমিতে লবণাক্ততা ধরা পড়ে। এর পর গত বছর একটি সার্ভে করা হয়। কিন্ত তার ফলাফল এখনও প্রকাশ করা হয়নি।

কৃষিজমিতে সেচ উপযোগী পানিতে লবণের স্বাভাবিক মাত্রা ধরা হয় ০.৭৫ ডিএস/মিটার। পানিতে লবণের মাত্রা এর বেশি হলে সেচ অনুপযোগী হয়ে পড়ে। নড়াইল জেলার বিভিন্ন এলাকায় নদী ও খালের পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা ১.৭৫ ডিএস/মিটার পর্যন্ত পাওয়া গেছে।

সরেজমিন কথা হয় নড়াইল সদরের মুলিয়া এলাকার প্রান্তিক কৃষক হরজিৎ বিশ্বাসের সঙ্গে। এ সময় তিনি বলেন, যে জমিতে লবণপানি প্রবেশ করে সেই জমির ফসল নষ্ট হয়ে যায়। জমির সার খরচ বেশি লাগে। সেচ খরচ ও সার খরচ বেশি হওয়ায় বোরো আবাদে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায় কৃষকদের।

ফলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নড়াইল সদর ও কালিয়া উপজেলার হাজার হাজার কৃষক। আরেক কৃষক রতন ঘোষ বলেন, লবণপানি প্রবেশ করায় মুলিয়া, বাহিরগ্রাম, আকদিয়াসহ বেশ কয়েকটি এলাকার কৃষকরা জমিতে বছরে একটি ফসলের বেশি আবাদ করতে পারছেন না। অথচ এসব এলাকায় কয়েক বছর আগেও বছরে তিনটি করে ফসল ফলাত কৃষকরা।

টিএইচ