রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪
ঢাকা রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
The Daily Post
বাংলাদেশ ব্যাংক

আমানতের চেয়ে তিন গুণেরও বেশি ঋণ বিতরণ

নিজস্ব প্রতিবেদক

আমানতের চেয়ে তিন গুণেরও বেশি ঋণ বিতরণ

দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় বার্ষিক আমানত এবং ঋণ দুটোই বৃদ্ধি পেয়েছে। যে প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকবহির্ভূত বলে চিহ্নিত করা হয়। তবে বছরের ব্যবধানে আমানতের তুলনায় ঋণ বিতরণ বেড়েছে তিন গুণেরও বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সাল শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় আমানত দাঁড়িয়েছে ৪৪ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৪৩ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা। সেই হিসাবে বছরের ব্যবধানে আমানত বেড়েছে ১ হাজার ৭৮ কোটি টাকা।

একই সময়ে ঋণ বিতরণ হয়েছে ৭৩ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এ অঙ্ক ছিল ৭০ হাজার ৩২১ কোটি টাকা। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে ঋণ বিতরণ বেড়েছে ৩ হাজার ৪৩৮ কোটি টাকা। এই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে আমানতের তুলনায় ঋণ বিতরণ বেড়েছে তিন গুণের বেশি।

অন্যদিকে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে এ খাতে আমানত দাঁড়িয়েছে ৪৪ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। একই সময়ে ঋণ বিতরণ হয় ৭৩ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ আমানতের তুলনায় ঋণ বিতরণ বেড়েছে ২৮ হাজার ৯২৯ কোটি টাকা।

এর আগে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমানত বেড়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। অনিয়ম ও ঋণ জালিয়াতির ঘটনার পর গ্রাহকদের টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় এ খাতে আমানত প্রবাহ কমতে থাকে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে আমানত কমে ৪১ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকায় নেমে আসে। একই বছরের ডিসেম্বর শেষে তা আবার বেড়ে হয় ৪৩ হাজার ৭৫২ কোটি টাকার বেশি। কিন্তু ২০২৩ সালের শুরুতে আমানত আবার কমে যায়। গত বছরের মার্চ শেষে আমানত কমে ৪৩ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকায় নামে। জুন শেষে তা আবার বেড়ে ৪৪ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা হয়। সেপ্টেম্বরে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৪৪ হাজার ৭২০ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টদের মতে, দুর্নীতি, অনিয়ম আর ঋণ কেলেঙ্কারির ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানতের তুলনায় ঋণ বিতরণ বাড়ছে। এতে এসব প্রতিষ্ঠানে বাড়ছে মাত্রাতিরিক্ত হারে খেলাপি ঋণ। অন্যদিকে, নানা অনিয়ম ও বেনামে নিজেদের প্রতিষ্ঠানের আমানত আত্মসাতের কারণে ইতোমধ্যেই কয়েকটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব ঝুঁকিতে পড়েছে। নিজেদের জমানো অর্থ ফেরত পেতে দীর্ঘদিন ধরে আমানতকারীরা এসব প্রতিষ্ঠানের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। এতে গ্রাহকদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে।

যাচাই-বাছাই ছাড়া অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করায় এসব প্রতিষ্ঠান আর ঋণ আদায় করতে পারছে না। ফলে অব্যাহতভাবে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। তাদের মতে, এসব প্রতিষ্ঠানে সুশাসনের ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ফলে দিনে দিনে এসব প্রতিষ্ঠানের পরিণতি আরও খারাপ হচ্ছে। আর ভোগান্তিতে পড়ছেন আমানতকারীরা। তাই এ বিষয়ে আর সময় নষ্ট না করে কার্যকর উদ্যোগ তথা প্রয়োজনে বন্ধ করে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর আমার সংবাদকে বলেন, চার-পাঁচটা বাদে বাকি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেওয়া উচিত। কারণ, তারা আমানতকারীদের প্রতারিত করছে। বেশি মুনাফার ফাঁদ পেতে তারা গ্রাহকের টাকা নিয়ে নিজেরা লুট করে নিচ্ছে। এখন এসব প্রতিষ্ঠান বিতরণকৃত ঋণ আদায় করতে না পেরে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। ফলে তারা এখন নতুন আমানতকারীদের নতুন নতুন ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে।

তিনি বলেন, যারা ইতোমধ্যে এই ফাঁদে পা দিয়েছে, তারা তো গেছেই। নতুন করে যেন কেউ এই ফাঁদে না পড়ে, সেই দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সরকার এই বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেয়নি। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত তাদের সব ধরনের ঋণ কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে আমানতকারীদের আমানত ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করা। এসব প্রতিষ্ঠান না থাকলেও দেশের আর্থিক খাতে কোনো প্রভাব পড়বে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে বর্তমানে ৩৫ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৩১০ শাখা রয়েছে। এর মধ্যে শহরে আছে ২৮৬ ও গ্রামীণ এলাকায় ২৬টি শাখা। এ ছাড়া ৩৫ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানত ও ঋণের হিসাব সংখ্যা ৬ লাখ ৯০ হাজার ২৬৭।

ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর ও সিলেটে আর্থিক খাতের আমানত বেড়েছে। বরিশাল ও ময়মনসিংহ বিভাগে আমানত কমেছে। আর ঋণ বিতরণ বেড়েছে ঢাকা, বরিশাল ও রংপুরে। কমেছে চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট ও ময়মনসিংহে।

বছর শেষে আর্থিক খাত থেকে সবচেয়ে বেশি ঋণ দাঁড়িয়েছে ঢাকা বিভাগে। এই বিভাগে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ৮৩ দশমিক ৩১ শতাংশ। চট্টগ্রামে বিতরণ করা হয়েছে মোট ঋণের ৯ দশমিক ৫১ শতাংশ, রাজশাহীতে ২ দশমিক ১০, খুলনায় ২ দশমিক ০১, বরিশালে ২ দশমিক ৫৫, সিলেটে দশমিক ৮৮, রংপুরে দশমিক ৭৮ এবং ময়মনসিংহে দশমিক ৯০ শতাংশ।

এ ছাড়া আর্থিক খাতের বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে ১১০ কোটি টাকা সরকারি এবং বেসরকারি খাতে ৭৩ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪৫ দশমিক ৬০ শতাংশই গেছে শিল্পে। ২৫ দশমিক ৯৯ শতাংশ বাণিজ্য, ভোক্তা খাতে ১৪ দশমিক ২২ এবং ৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ নির্মাণ খাতে বিতরণ করা হয়।

টিএইচ