হাসনাত আবদুল্লাহ জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক। ২০২৪ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে গড়ে ওঠা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর অন্যতম সমন্বয়ক হিসেবে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকারের পতনের দাবিতে রাজপথ কাঁপিয়ে গড়ে ওঠা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এই সময় রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের শিকার হয়ে তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। পুলিশের হাতে বন্দী থেকে ট্রমার মধ্য দিয়েও দিনযাপন করতে হয়।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘৯ জুলাই ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে একটা কর্মসূচি দুই দিন চলে। এরপর একদিন বিরতি নিয়ে আমাদের সমন্বয়ক টিমকে ভাগ করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঠাই, আমি ‘কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে গিয়ে ছাত্রদের সাথে কথা বলি। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যেখানে পুলিশের বাধার সম্মুখীন হয়েছে সেই স্থানগুলো দেখে ছাত্রদের নির্দেশনা দেই। সমন্বয়করা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। সমন্বয়কদের নেতৃত্বে সারা দেশে শিক্ষার্থীরা সুসংগঠিত হতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও সমন্বয়ক নির্বাচিত করার পর বিভিন্ন কার্যক্রম অব্যাহত থাকে।’
তিনি বলেন, ‘১৪ জুলাই রাষ্ট্রপতির কাছে আমরা স্মারকলিপি দিয়ে হলে ফিরি, ওইদিন গণভবনে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার একটা প্রেস কনফারেন্স ছিল। সেই প্রেস কনফারেন্সে শেখ হাসিনা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের রাজাকারের নাতি-পুতি বলে আপত্তিকর বক্তব্যের পর ওই রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা প্রতিবাদ জানাতে স্লোগান নিয়ে রাজপথে নেমে আসেন।’
সেদিন রাতে একটা আইকনিক মিছিল ঢাকাসহ সারা দেশ প্রকম্পিত করেছিল একটি স্লোগান দিয়ে ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার! রাজাকার!!’ ‘কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার।’ সে রাতে রোকেয়া হল, শামসুন্নাহার হল, ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল, কুয়েত মৈত্রী হল থেকেও ছাত্রীরা রাস্তায় নেমে আসে।
হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘১৫ জুলাই দুপুর ১২টায় আমরা রাজু ভাস্কর্যে একটি কর্মসূচি দেই। ছাত্রলীগ পাল্টা কর্মসূচি দেয়। রাজু ভাস্কর্য থেকে আমরা যখন হলের দিকে প্রতিদিনকার মতো মিছিল নিয়ে আসতে থাকি, তখনই বিজয় একাত্তর হলে ছাত্রলীগ নৃশংসভাবে আমাদের শিক্ষার্থীদের ওপর অতর্কিতভাবে হামলা চালায়। ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এই আন্দোলন দমন করার জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ট।’ তারা নারী শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পিটিয়ে আহত করে। রেজিস্টার বিল্ডিংয়ের সামনে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের শাকিরুল ইসলাম শাকিল আমাকে বাজেভাবে পিটিয়ে আহত করে। আমার বাঁ পায়ে জখম হয়।
তিনি বলেন, ৯ জুলাই ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির আগে সর্বপ্রথম আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন শাহবাগ থেকে আমাদের ডেকে নিয়ে যায়। আমাদের সাথে নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ছিলো। তখন টিএসসিতে ওই কর্মকর্তা জিজ্ঞেস করেন, আমাদের মোটিভ কী? আমরা বারবার বলেছি, রাষ্ট্রের মধ্যে যে বৈষম্য আছে তা নিরসনের জন্য আমরা আন্দোলন করছি। শাহবাগ থানার পুলিশসহ অন্যান্য জোনের পুলিশও ছিল সেখানে। পুলিশ প্রেশার দিতে থাকে আমরা যেন আন্দোলন তুলে নেই। হাসনাত বলেন, ‘ছাত্রলীগ মনে করেছিল ১৫ জুলাইয়ে হামলা করেই আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়া যাবে। কিন্তু ১৬ জুলাই আরও বেশি শিক্ষার্থী শহীদ মিনারে জড়ো হয়। একই দিন দুপুরে আমরা একটি অনলাইন মিটিং করছিলাম। মিটিংয়ে আমি, নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, আসিফ মাহমুদ, বাকের, হাসিব থেকে শুরু করে অন্যরাও উপস্থিত ছিল। এ সময় খবর পাই যে রংপুরে আবু সাঈদকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছে। তখন আমরা ওই মিটিংয়েই সিদ্ধান্ত নেই আর কোনো সংলাপ হবে না। ‘রক্ত মাড়িয়ে কোনো সংলাপ নয়’।
তিনি বলেন, ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ভিসি চত্বরে গায়েবানা নামাজে জানাজা চলাকালীন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা আমাদের কনস্ট্যান্টলি ফোর্স করতে থাকে যেন গায়েবানা নামাজে জানাজা না করি। গায়েবানা নামাজে জানাজা শেষ করে আমরা যখন কফিন কাঁধে মিছিল নিয়ে ভিসির বাসভবনের সামনে দিয়ে রাজু ভাস্কর্যের দিকে যেতে চাই, তখনই আমাদের দুই দিক থেকে মুহুর্মুহু টিয়ার শেল এবং সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়তে থাকে।’
তিনি বলেন, ‘সেদিন বিকেল ৫টার মধ্যে হলগুলো খালি করার নির্দেশ দিয়ে তা বন্ধ করে দেয়া হয়। ভিসি আন্দোলন প্রত্যাহারের চাপ দেন। হল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমরা সবাই বিক্ষিপ্ত হয়ে যাই। তখন আন্দোলন সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী (নওফেল) সংলাপের প্রস্তাব দেন।’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন আমাদের বলে, মিটিং করার জন্য একটা জায়গায় আমাদের যেতে হবে। মিটিং করা সম্ভব না বললে তারা আমাদের জোরপূর্বক রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মাতে নিয়ে যায়। সেখানে তিন মন্ত্রী প্রবেশ করেন। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাতের সাথে মিটিং করতে না চাইলে ৪০ মিনিট পর তারা চলে যান। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ক্ষুব্ধ হয়ে আমাদের একটি সেইফ হোমে নিয়ে রাখে।’
হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, পরদিন আমাদেরকে জুমার নামাজ পড়তে দেয়া হয়নি। তিন মন্ত্রীর সাথে দেখা না করায় আমাদেরকে আগের দিন সারারাত পৃথকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আমাকে একবার, সারজিসকে একবার, এভাবে পালাক্রমে জিজ্ঞাসাবাদ চলতে থাকে। তারা আমাকে বলে, সারজিস রাজি হয়ে গেছে। সারজিসকে বলে, আমি রাজি হয়ে গিয়েছি। নানাভাবে পারিবারিক বিষয়গুলো টেনে এনে ভয়ভীতি দেখানোর চেষ্টা করা হতে থাকে। তিনি বলেন, একপর্যায়ে আমাকে কিচেন রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। জুমার নামাজের পরে আরেকটা টিম আমাদের কাছে আসে এবং তারা আরো বেশি অ্যাগ্রেসিভ হয়। প্রথম লাঞ্ছনার শিকার হই। আমাকে কিচেনে একপর্যায়ে থাপ্পড় দেয়া হয়। আমাকে বলে যে, আমার পরিবার তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। নাহিদসহ আরো যারা আন্দোলনকারী আছে তাদেরকে নিয়ে আমরা যেন মিটিং করি।
হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে প্রেস কনফারেন্সের দিনও প্রেশার দেয়া হয় এটা বলার জন্য যে, আমরা আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন আমাদেরকে প্রেশার দেয়, আমরা যেন মিটিং করি। তার পর থেকে আমি আমার স্মার্টফোন ব্যবহার বন্ধ করে দেই। একটা বাটন ফোন ব্যবহার করা শুরু করি। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির প্রেস কনফারেন্সের পরে আমি মামার বাসায় না গিয়ে কাঁটাবনে আমার বন্ধুর সাথে থাকি। ওই দিন রাতেই আমি আবার মামার বাসায় চলে আসি। সারজিসকেও সেখানে আসতে বলি। নাহিদ ইসলামকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে নিরাপত্তা বাহিনী সদস্যরা এসে সাইন্সল্যাবের বাসা থেকে আমাদেরকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর তারা আমাদেরকে গাড়িতে সারা ঢাকা ঘোরায়। তার পর আমাদেরকে তাদের অফিসে নিয়ে যায়।’
হাসনাত বলেন, নিরাপত্তা বাহিনীর অফিসের প্যাটার্ন ছিল এই টাইপের একটা জায়গায় ৩০ জনের মতো অফিস করে। বাথরুম হচ্ছে একটা। সারাদিন আমাদেরকে বাথরুমের সামনে বসিয়ে রাখত। বসার জায়গা নেই, শোয়ার জায়গা নেই, কমপ্লিটলি ওই অফিসে পেপার-পত্রিকা সব বন্ধ, মোবাইল বন্ধ, টিভি বন্ধ। সে সময় নিরাপত্তা বাহিনীর এক সদস্য আমার সাথে খুবই রূঢ় আচরণ করে। সে আমাকে খাবারে সমস্যা করেছে এবং সারারাত বাথরুমের সামনে বসিয়ে রাখত। নিরাপত্তা হেফাজত থেকে এক দিন আমাদের গার্ডিয়ানদের আসতে বলা হয়। আমার এক ভগ্নিপতি আসেন আমাকে নেয়ার জন্য। ওনাকে রাত ১১টা পর্যন্ত বসিয়ে রেখে বলেন, আপনি চলে যান। কোনো ডিসিশন হয়নি।’
টিএইচ