রবিবার, ১৩ জুলাই, ২০২৫
ঢাকা রবিবার, ১৩ জুলাই, ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২
The Daily Post

ত্রাণ নয়, স্থায়ী মুক্তি চায় পানিবন্দি নোয়াখালীবাসী

নোয়াখালী প্রতিনিধি

ত্রাণ নয়, স্থায়ী মুক্তি চায় পানিবন্দি নোয়াখালীবাসী

প্রলয়ঙ্করী বন্যার কবলে নোয়াখালী। টানা বর্ষণ আর পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলে জেলার জনজীবন আজ লন্ডভন্ড। প্রায় ২ লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় ধুঁকছে চরম দুর্ভোগে। আকাশ মেঘমুক্ত, সূর্যের তেজ থাকলেও পানি নামছে ধীরগতিতে, যেন প্রকৃতির এই নীরব ক্রোধের কাছে অসহায় মানুষ। জেলা শহরের প্রধান সড়কটুকু ছাড়া অধিকাংশ রাস্তাঘাট ডুবে আছে পানিতে, অসংখ্য বাড়িঘর পরিণত হয়েছে ভাসমান দ্বীপে। ফুঁসছে স্থানীয়দের ক্ষোভ, তারা আর সাময়িক ত্রাণ নয়, চায় চিরস্থায়ী মুক্তি এই বার্ষিক জলযন্ত্রণা থেকে।

নোয়াখালী পৌরসভার ড্রেনগুলো পরিষ্কার করা হয়েছিল বটে, কিন্তু অধিকাংশ বাড়িঘর থেকে যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা, বিশেষ করে পলিথিন ড্রেনে ফেলায় অল্প দিনেই সেগুলো ভরে উঠেছে। এটি যেন এক দুঃস্বপ্ন, যা প্রতি বছর ফিরে আসে।

পৌরসভার কাদিরানি বাসিন্দা মোহাম্মদ রবিউল হাসান হতাশা নিয়ে বলেন, পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থার অভাব আর পানি নিষ্কাশনের নালায় জলাশয়গুলো ভরাট হয়ে যাওয়াই আমাদের এই দুর্ভোগের মূল কারণ। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাই এর জন্য দায়ী। সামান্য বৃষ্টিতেই আমাদের এলাকা অথৈ পানিতে তলিয়ে যায়!

চারদিনের টানা ঢল আর বৃষ্টির পর নোয়াখালীর আকাশে যদিও দুদিন ধরে রোদ হাসছে, তাতেও কিছু এলাকার পানিরবদ্ধতা সামান্যই কমেছে। বরং, বেগমগঞ্জ উপজেলার হাজীপুর, দুর্গাপুর, ও সেনবাগের পূর্বদিকে ডুমুরিয়ার উত্তর পাশ থেকে সোনাইমুড়ি পর্যন্ত  কয়েকটি গ্রামে পানি উলটো বেড়েছে! স্থানীয়দের ধারণা, ফেনীর দিক থেকে আসা পানিই এই অপ্রত্যাশিত বৃদ্ধির কারণ।

শনিবার (১২ জুলাই) সেনবাগ, বেগমগঞ্জ, সোনাইমুড়ি পূর্বাঞ্চল ও কবিরহাট উপজেলার বেশিরভাগ এলাকায় পানি নামছে শম্বুক গতিতে। ফলস্বরূপ, জনদুর্ভোগ পৌঁছেছে চরম সীমায়।

সেনবাগের অর্জুনতলা ইউনিয়নের আমির হোসেন বলেন, আজ শুধু হতাশা নয়, তীব্র ক্ষোভ ২০২৪ সালের বন্যায় ভিটেমাটি হারাবার পর ভেবেছিলাম, এবার বুঝি স্থায়ী একটা ব্যবস্থা হবে। কিন্তু না, ২০২৫ সালেও আবার একই দুর্ভোগ! আমাদের জোরালো দাবি ত্রাণ চাই না, স্থায়ীভাবে বন্দোবস্ত চাই!

সেনবাগ ডুমুরিয়া ইউনিয়নের এক বাসিন্দা জানান, গাজীরহাট থেকে যত পূর্বদিকে যাবেন, শুধু পানি আর পানি! এত উঁচু এলাকাও ডুবে গেছে, অনেকের ঘরবাড়ি পানির নিচে। আমরা ত্রাণ চাই না, স্থায়ী বন্দোবস্ত চাই!

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয়ের তথ্যমতে, এবারের বন্যায় জেলার ৬টি উপজেলার ৫৭টি ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রায় ৪৬ হাজার ৭০টি পরিবারের ১ লাখ ৯২ হাজার ৫০৩ জন মানুষ এখন পানিবন্দি। কবিরহাট ও সুবর্ণচর উপজেলায় ৪৫টি বসতঘর আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এগুলো শুধু সংখ্যা নয়, এগুলি শত শত মানুষের ছিন্নভিন্ন স্বপ্ন আর ভাঙা সংসার। জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা মো. মাসুদুর রহমান জানিয়েছেন, ৪৭টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১ হাজার ৮৫০ জন মানুষ ও ১৭১টি গবাদিপশু আশ্রয় নিয়েছে। ৫১টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে, যার মধ্যে ২৯টি কাজ শুরু করেছে। ক্ষয়ক্ষতির প্রতিবেদন ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

সোনাপুর সরকারি মুরগির খামার রোড, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, মাইজদীর বড় মসজিদ দুধ হাউজিং এলাকা, নোয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয় রোড, জেলা শিল্পকলা একাডেমিসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় এখনো রাস্তাঘাট ডুবে আছে। আশপাশের অনেক বাসাবাড়িতেও পানি জমে। টানা বৃষ্টির বিরতি কিছুটা স্বস্তি দিলেও, জলাবদ্ধতা ও বন্যা পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি।

নোয়াখালী জেলার আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম আশার বাণী শোনাচ্ছেন, গত ২৪ ঘণ্টায় তেমন বৃষ্টি হয়নি, আপাতত ভারী বৃষ্টিরও সম্ভাবনা নেই, তবে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হতে পারে। জেলা প্রশাসক খন্দকার ইসতিয়াক আহমেদ বলেন, পানি নিষ্কাশনে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। বৃষ্টি না হলে দ্রুত উন্নতি হবে।

নোয়াখালী আজ এক কঠিন প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে ধনীর জেলা হিসেবে পরিচিত এই নোয়াখালী যদি প্রতিবছর এভাবে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে তার এগিয়ে চলা কি সম্ভব? মানুষ আর ত্রাণ চায় না, তারা চায় একটি স্থায়ী সমাধান, যা তাদের জীবনকে প্রতি বছরের এই অভিশাপ থেকে মুক্তি দেবে। প্রশাসন কি এই নীরব কান্না শুনতে পাচ্ছে?

টিএইচ