অযৌক্তিকভাবে কয়লার মূল্য কমিয়ে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনিকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধন করছে খনির শ্রমিক ও কর্মচারীরা।
বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই)কয়লা খনি এলাকায় শ্রমিক কর্মচারীরা মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশে দাবি করেন অযৌক্তিকভাবে কয়লার দাম কমিয়ে দিয়ে খনি বন্ধের চক্রান্ত করা হচ্ছে। পিডিবির কাছে প্রতিটন কয়লা ১৭৬ ডলারের পরিবর্তে বর্তমানে ১০৪ ডলারে বিক্রি বন্ধ করতে হবে।
বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি বোর্ড এ বিদ্যুতের লোক দিয়ে চালানো যাবে না। ৭ দফা দাবি মেনে না নিলে আগামীতে কঠোর কর্মসূচির ঘোষণা করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন আন্দোলনকারী।
আন্দোলনকারীদের দাবি কয়লাখনি বন্ধ হয়ে গেলে আড়াইহাজার শ্রমিক কর্মচারী চাকরি হারাবে। হুমকির মুখে পড়বে এই এলাকার লক্ষাধিক মানুষ।
জানা যায়, বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠা বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণেই হুমকির মুখে পড়েছে কয়লা খনির ভবিষ্যৎ। তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছে সাড়ে ৮শ কোটি টাকা পাওনা, পূর্ণাঙ্গ উৎপাদনে যাওয়ার অক্ষমতার কারণে কোন ইয়ার্ড পড়ে থাকা সাড়ে ৪ লাখ টন কয়লার স্তূপ ও উৎপাদন খরচের চেয়ে কম মূল্য পরিশোধ করায় চরম বিপাকে পড়েছে খনি কর্তৃপক্ষ। অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে কয়লা খনির ভবিষ্যৎ।
আরও জানা যায়, ২০০৫ সালে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যাওয়ার পর ২০০৬ সালে তার পাশেই গড়ে উঠে ১ ও ২নং ইউনিটের ১২৫ করে মোট ২৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র। তখন ৬৫ শতাংশ কয়লা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে এবং ৩৫ শতাংশ কয়লা দেশিয় বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রয় করা হত। সরকারি প্রতিষ্ঠান বিপিডিবি (বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড)-এর কাছে বিক্রয় মূল্যের চেয়ে বাহিরে বিক্রয় মূল্য সব সময় বেশি থাকায় ২০০৮ সাল থেকে খনিটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
২০১৮ সালে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে ২৭৫ মেগাওয়া ক্ষমতা সম্পন্ন ৩য় ইউনিট চালুর পর কেন্দ্রটির মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা দাঁড়ায় ৫২৫ মেগা ওয়াট। ফলে সরকার বাহিরে বিক্রয় বন্ধ করে উৎপাদিত কয়লার শতভাগ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সরবরাহের সিদ্ধান্ত নেয়।
সরকারি সিদ্ধান্তে উৎপাদনের শুরুতে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছে ৬০ মার্কিন ডলার প্রতিটন কয়লার বিক্রয় মূল্য নির্ধারণ করা হলেও পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে ৭০, ৮৪, ১০৫, ১৩০ ও সর্বশেষ ২০২২ সালের জানুয়ারি হতে ১৭৬ মার্কিন ডলার দরে পরিশোধ করে আসছিল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
কিন্তু ২০২৪ সালের ৪ নভেম্বর হতে খনির একমাত্র ক্রেতা বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের সচিব ফারজানা মমতাজ কয়লা খনি পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান এবং বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য (অর্থ) অঞ্জনা খান মজলিশ পর্ষদ পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পাওয়ার পর ক্রেতাই হয়ে যায় বিক্রেতা, যা স্বার্থের সংঘাতে পরিণত হয়। তারপর থেকেই কয়লার মূল্য নির্ধারণ ও পরিশোধে দেখা দেয় আরোও বেশী জটিলতা।
চলতি বছর ১৯ জানুয়ারি কয়লার বকেয়া বিলে আরোপিত বিলম্ব মাশুল মওকুফ বিষয়ে বিদ্যুৎ সচিবের সভাপতিত্বে বিদ্যুৎ বিভাগে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হলেও সে সভায় কয়লার মূল্য আইসিআই (ইন্দোনেশিয়া কোল ইনডেক্স) রেটে ১০৪ ডলার নির্ধারণ, বিলম্ব মাশুল মওকুব ও ১২২ কোটি ৮৩ লাখ ৩৬ হাজার টাকা অবলোকন করে এবং ৩০০ কোটি টাকা ২৪ কিস্তিতে পরিশোধের সিদ্ধান্ত নেয়। আর তখন থেকেই ১০৪ ডলার হিসাবে পরিশোধ করে আসছে পিডিবি। এভাবে চললে অচিরেই উত্তরাঞ্চলের একমাত্র লাভজনক শিল্প প্রতিষ্ঠানটি লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। তবে এ লক্ষ্যে সমস্ত তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণপূর্বক কয়লার মূল্য নির্ধারণে প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য গত ৭ এপ্রিল একটি ৯ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করে দিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এই প্রতিবেদনের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে বলে জানা গেছে।
খনি কর্তৃপক্ষ বলছে বিদ্যুৎ ও উত্তরাঞ্চলের সার্বিক উন্নয়নে পেট্রোবাংলা এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা গত ২০ বছর যাবত শত প্রতিকূলতার মধ্যেও নিরলসভাবে ভূ-গর্ভ হতে কয়লা উত্তোলন করে আসছে খনি কর্তৃপক্ষ। এ কয়লা বিক্রয়ের আয় দিয়েই, বিদেশি ঠিকাদারের বিল পরিশোধ, কর্মচারীদের বেতন ভাতা পরিশোধ, খনি পরিচালন, অনুসন্ধান, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও সরকারের রাজস্ব আদায়সহ সামগ্রিক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে কিন্তু এভাবে চললে অচিরেই লাভজনক খনিটি লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে ।
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান বন্ধ হবে। এলাকাবাসীর মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা দেখা দিবে। জ্বালানি সেক্টর ও উত্তরাঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হবে।
৫২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ২ নম্বর ইউনিট ২০২০ সাল থেকেই পুরোপুরি বন্ধ হয়ে আছে, যা চালু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ১ নম্বর ইউনিটের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা অনেকাংশে কমে গেছে, ফলে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে মধ্যে মধ্যে বন্ধ থাকে এবং ৩ নাম্বার ইউনিটিও গত ফেব্রুয়ারি মাসে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে প্রায় ১৫ দিন বন্ধ ছিল। তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র তাদের নির্ধারিত লক্ষ্য মাত্রায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যর্থ হওয়ায় বছরে ১৫ লাখ টনের চাহিদার বিপরীতে ৭/৮ লাখ টন কয়লা ব্যবহার করছে। ফলে কোল ইয়ার্ডে বিপজ্জনক উচ্চতায় প্রায় সাড়ে ৪ লক্ষ মেট্রিক টন কয়লার স্তূপ জমে আছে। যাতে ভিতরে ভিতরে সেলফ এক্সপ্লোরেশন ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে, যা আগেই বাহির থেকে বুঝা সম্ভব নয়। তাহলে কয়লার প্রজননক্ষমতা ও ওজন অনেকাংশে কমে যাবে।
একটি সূত্রে জানা যায় আইসিআই ইনডেক্স অনুযায়ী আমদানিকৃত কয়লার ক্যালোরিফিক ভ্যালু ৪৫০০-৫০০০ কিলো ক্যালরি/কেজি, যার ময়েশ্চার ২৮-৩০ শতাংশ। অপরদিকে কয়লা খনির উৎপাদিত কয়লার ক্যালোরিফিক ভ্যালু ৬১৩৭ কিলো ক্যালরি/কেজি এবং ময়েশ্চার ৩.৩৯ শতাংশ অর্থাৎ বিদেশি কয়লার চেয়ে বড়পুকুরিয়ার কয়লার গুণগত মান অনেক বেশি। যার কারণে বছরে দেশীয় বাজারে এর চাহিদা প্রায় সাড়ে ৬ লাখ টন এবং বর্তমান খোলা বাজারে এ কয়লার মূল্য প্রায় ২০০-২৫০ মার্কিন ডলার।
টিএইচ